The Daily Janakantha 12/06/2011
পালাক্রমে ধর্ষণ শেষে নিথর দেহ ভাসিয়ে দেয় নদীতে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (১)
তপন বিশ্বাস ॥ ২০০১ সাল, নির্বাচন পরবর্তী ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কলঙ্কের জন্ম দেয় । সারা দেশে একযোগে সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি লণ্ড ভণ্ড, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির নারকীয় তাণ্ডব, হত্যা, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, নির্যাতন ও অগি্নসংযোগসহ এমন কোন হীন কাজ নেই যা ঘটেনি। পাশবিক। জান্তব আক্রোশ। হিংস্রতা। প্রতিটি ঘটনা যেন মথিত হৃদয়ের বেদনার্থ সমগ্রতা নিয়ে জীবন্ত অসহায় চিৎকারে বলেছিল_ এই কি আমাদের জন্মভূমি।
আসলে কি ঘটেছিল ওই সময়ে। এই ঘটনা তদন্তের লক্ষে গঠিত তদন্ত কমিশনের অনুসন্ধানে তার চিত্র ফুঁটে উঠেছে। ধারাবাহিক পর্বে চাঞ্চল্যকর এ সব ঘটনার বর্ণনা থাকছে।
অবশ্য ইতোমধ্যে ওই সময়ের ঘটনা তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পেশ করেছে কমিশন। অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে প্রধানকরে গঠিত তিন সদস্যের কমিশন মর্মস্পর্শী তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার পর দেড়মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনকভাবে সরকার রয়েছে নীরব। সরকারের রহস্যজনক এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অথচ এ ঘটনা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে মানবতা হয়েছিল লাঞ্ছিত। সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি হয়েছিল লণ্ডভণ্ড। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাবিরোধী শক্তি বাংলাদেশজুড়ে শুরু করে নারকীয় তাণডব। এদের সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, শারীরিক নির্যাতন ও অগি্নসংযোগের মতো অসংখ্য ঘটনা মানবতা ক্রন্দনরত। বিদীর্ণ বাংলাদেশ। নির্মম। পাশবিক। জান্তব আক্রোশ। হিংস্রতা। প্রতিটি ঘটনা যেন মথিত হৃদয়ের বেদনার্থ সমগ্রতা নিয়ে জীবন্ত অসহায় চিৎকারে বলছে: এই কি আমাদের জন্মভূমি। এই প্রতিবেদন অশ্রউ, আর্তনাদ, নীরব বেদনা, হৃদয়ানুভূতি ও উপলব্ধির বিবেক যন্ত্রণায় বিদ্ধ রম্নদ্ধকালের ঘটনাপঞ্জি।
তদনত্ম কমিশন ৮ম জাতীয় সংসদ ২০০১ নির্বাচনোত্তর খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অগি্ন সংযোগসহ সকল মানবতাবিরোধী সহিংসতায় আক্রানত্ম নিরীহ ব্যক্তি ও পরিবারের শোক, দুঃখ ও বেদনার কাহিনী তুলে ধরেছে। এ সময় চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীরা সারা দেশে যে সহিংসতা চালিয়েছে তা মধ্যযুগীয় নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে।
তদনত্ম রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাত অর্থাৎ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে শুরম্ন হয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাচন। সংখ্যালঘুর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ওপরও শুরম্ন হয় এই নির্যাতন। নৌকা মাকর্ায় ভোট দেয়ার অভিযোগে নির্যাতন শুরম্ন হলেও মুহূর্তে এতে নতুন মাত্রা যোগ হয় অসহায় সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ। যুবদল-ছাত্রদলের এই মিশন থেকে রেহাই পায় না বৃদ্ধা। গর্ভবতী মহিলারাও এমনকি সম্ভ্রম রৰা করতে গিয়ে পাট ৰেতে বাচ্চা প্রসব করার ঘটনাও ঘটে এ সময়। জোট সরকারের পৈচাশিক চেহারা মুহূর্তে প্রকাশ পায় তাদের অনুসারীদের কর্মকা-ে। রাতভর ধরে চলে ধর্ষণ। গ্রাম ঘিরে ধর্ষণে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এই নরপিচাশরা। এ সময়ে বাগেরহাটে এক কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণকালে তার মা উচ্চস্বরে বিলাপ করতে করতে বলেছিল, বাবারা তোমরা একজন করে আস, আমার মেয়ে ছোট। এতেও ৰানত্ম হয়নি নরপিচাশরা। কিশোরী মেয়ের ওপর হায়নার দল যেন আছড়ে পড়ে।
একই পরিবারের তিন থেকে পাঁচ সংখ্যালঘু নারী এক সঙ্গে ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। কোথাও মা মেয়ে এক সঙ্গে, কোথাও মা মেয়ের সঙ্গে পুত্রবধু এবং পুত্রবধুর মাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আবার কোথাও স্বামীকে বেঁধে তার ও সনত্মানদের সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে তারা। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী থেকে ডিগ্রী পড়ুয়া সংখ্যালঘু মেয়েদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েদের তুলে নিয়ে এরা মদ খেয়ে পালক্রমে ধর্ষণ করে। ভোলার লাল মোহনে অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের চার পাশের ধানৰেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভেন্ডার বাড়িতে অর্ধশতাধিক মহিলারা তাদের সম্ভ্রম রৰার লৰ্যে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সে বাড়িটিও এই নরপিচাশদের নজর এড়ায়নি। শত শত বিএনপি সন্ত্রাসীরা ৮/১০টি দলে বিভক্ত হয়ে অত্যনত্ম পরিকল্পিতভাবে ওই রাতে হামলা চালায়। মহিলারা তাদের সম্ভ্রম রৰা করতে পারেনি। সম্ভ্রম রৰায় অনেকে, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশেপাশের ধানৰেত ও জলাশয়ে। কিন্তু তাদের শিশুদের পানিতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়ে পানি থেকে ওঠে আসতে বাধ্য করায়। সেখানে ধর্ষিত হয় ৮ বছরের শিশুও। মা, মেয়ে, পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয় এক সঙ্গে। ছেলের চেয়েও ছোট বয়সী সন্ত্রাসী কর্তৃক মায়ের বয়সী নারী ধর্ষিত হয়। এদের কবল থেকে রৰা পায়নি পঙ্গু, অন্ধ, প্রতিবন্ধী নারীরাও। কোন কোন ৰেত্রে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়াসহ লোমহর্ষক অনেক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এতে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করায় যশোরের চৌগাছায় এক আওয়ামী লীগ ভক্ত আব্দুল বারিক ম-লকে তার বাড়িতে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিনে দুপুরে রামদা দিয়ে কোপ দিয়ে দুপা কেটে ফেলে। বড় ছেলে বাধা দিতে গেলে তার দুপায়ে গরম রড ঢুকিয়ে দেয়। এর পর তার বাড়িতে তারই গরম্ন জবাই করে ভোজের আয়োজন করে। নির্বাচনের পর কয়েকদিন ধরে চলে এই নারকীয় অত্যাচার। কিন্তু প্রশাসন থাকে নীরব। কোথাও কোথাও বরং এই নরপিচাশদের সহযোগিতা করেছে। তদনত্ম কমিটির রিপোর্টে এ বিষয়গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
তদনত্ম প্রতিবেদনে সহিংস ঘটনার প্রকৃতি অনুযায়ী ছয়টি সুপারিশ করে। এর মধ্যে ওই সময়ের অনেক ঘটনা রয়েছে, যা মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। এ জাতীয় সকল বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করা, কোন কোন মামলা পুনরম্নজ্জীবিত করা, তদনত্ম না করে যে সকল মামলা চূড়ানত্ম রিপোর্ট প্রদান করা হয়, সে সকল মামলার পুনর্তদনত্ম করা, কিছু মামলা রিভিউ করা, কিছু মামলা আপীল করা এবং সহিংস প্রতিটি ঘটনা তদনত্ম করে বের করতে প্রতিটি জেলায় ছোট আকারে তদনত্ম কমিশন বা কমিটি গঠন করা।
পরবর্তী করণীয় কী এমন এক প্রশ্নের জবাবে তদনত্ম কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, যে রায়ের আলোকে তদনত্ম কমিশন গঠন করা হয়েছে, সে রায়ের আলোকে পরবর্তী পদৰেপের জন্য সরকারই উপযুক্ত কর্তৃপৰ। এ ব্যাপারে নতুন করে আদালতের নির্দেশনা নেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সরকার কোন ৰেত্রে প্রয়োজন মনে করলে আদালতের কাছে পরবর্তী নির্দেশনা চাইতে পারে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেছিলেন, কিছু কিছু ৰেত্রে আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন হতে পারে। ২০০১ সালের অনেক ঘটনায় তখন মামলা দায়ের করা হয়নি বা করতে পারেনি। এ ঘটনার প্রেৰিত্রে এখন মামলা দায়ের করতে আদালতের নিদের্শনার প্রয়োজন হতে পারে। তবে আমরা বিষয়টি পরীৰা-নিরীৰা করে দ্রম্নত বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কিন্তু তদনত্ম কমিশন রিপোর্ট প্রদানের পর ৪৯ দিন অতিবাহিত হলেও এখনও কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কমিশনের সদস্য মনোয়ার হোসেন আখন্দ জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনার তদনত্ম করতে গিয়ে দেখতে পাই জনকণ্ঠ পত্রিকা দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে। জনকণ্ঠ পত্রিকার রিপোর্ট আমাদের সহায়ক হয়েছে। রিপোর্টে যে ঘটনাগুলো তুল ধরা হয়েছে, তদনত্ম করতে গিয়ে প্রতিটি ৰেত্রে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই সময়ের প্রতিদিনের নির্যাতনের চিত্র জনকণ্ঠের পাতায় ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, এ ছাড়া দায়িত্বশীল একটি ইংরেজী পত্রিকাতে মাত্র দুটি লেখা ছাপা হয়েছে। এ সময় বাকি মিডিয়া রহস্যজনকভাবে নীরব ছিল। তবে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রচার না করলেও তাদের ধারণকৃত দুটি ফুটেজ পেয়েছি। কমিশনের সভাপতিও একই কথা বলেছেন জনকণ্ঠ সম্পর্কে। তিনি বলেন, কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, জনকণ্ঠ কতবড় দায়িত্বলীল পত্রিকা। পত্রিকাটি সকল সময়ে নির্যাতিত মানুষের পার্শে দাঁড়ায়। অপর এক কর্মকর্তা বলেন, জনকণ্ঠ নির্যাতিত সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছিল বলে তাকেও কম মাসুল গুনতে হয়নি। এতে রীতিমতো সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। তৎকালীন সরকার পত্রিকাটির সকল বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েই ৰানত্ম হয়নি। কোম্পানির সকল ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় সংখালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি কিছু আওয়ামী নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের বাড়ি লুট, মায়ের সামনে কন্যাকে ধর্ষণ, স্বামীকে বেঁধে তার সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ, কোন কোন ৰেত্রে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়াসহ লোমহর্ষক অনেক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এতে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক হামলা হতে থাকে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, জমি দখল করা, হাত-পা কেটে নেয়া এবং খুন-ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
দলীয় আনুগত্যের কারণে সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্যাতন বন্ধ করতে প্রশাসনিকভাবে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে উলেস্নখ করা হয় প্রতিবেদনে। আবার জনগণের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন জবাবদিহি না থাকায় খেয়ালখুশিমতো প্রশাসন চালিয়েছে। বিশেষ করে, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রশাসনে রদবদলের মাধ্যমে সহিংস ঘটনার জন্য পথ সৃষ্টি করে গেছেন।
এ ধরনের নৃশংস ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে 'হিউম্যান রাইট ফর পিস' নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৬ মে এসব নির্যাতনের অভিযোগ তদনত্মের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে প্রধান করে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদনত্ম কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের দুই সদস্য হলেন উপসচিব মনোয়ার হোসেন আখন্দ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মীর শহিদুল ইসলাম।
তদনত্ম কমিশনের সুপারিশে ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর ঘটনার জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। অপরাধীদের বিরম্নদ্ধে দ্রম্নত মামলা করারও সুপারিশ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশিস্নষ্টতা ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার কারণেই এসব ঘটনা ঘটেছে।
পাঁচ খ-ের তদনত্ম প্রতিবেদনটি এক হাজার ৭৮ পৃষ্ঠার। তদনত্মকালে কমিশন মোট অভিযোগ পেয়েছে পাঁচ হাজার ৫৭১টি। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যনত্ম পাওয়া অভিযোগের সংখ্যা তিন হাজার ৬২৫। এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা ৩৫৫টি এবং লুটপাট, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পঙ্গুত্ব, গুরম্নতর আঘাত, সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য গুরম্নতর অভিযোগ তিন হাজার ২৭০টি। অভিযোগ বাতিল করা হয়েছে এক হাজার ৯৪৬টি। কমিশনের তদনত্ম করা তিন হাজার ৬২৫টি ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত। কমিশনের প্রতিবেদনে সহিংস ঘটনার কিছু উদাহরণ, কারণ ও পটভূমি, সহিংসতার ধরন, সারসংক্ষেপ, প্রাসঙ্গিক মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের বিবরণ আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেতাকর্মীদের পাঁচ হাজার ৮৯০টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে উলেস্নখ করে তদনত্ম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। রাজনৈতিক আক্রোশের কারণে কারও হাত-পা কেটে ফেলা হয়, কারও চোখ তুলে ফেলা হয়, অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয় মায়ের সামনেই।
কমিশন জানায়, ২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনায় যেসব ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল, লুটপাট চালানো হয়েছিল, গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তাঁরা থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের পর্যনত্ম করতে পারেননি। আবার কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারলেও রাজনৈতিক কারণে তদনত্ম করা হয়নি।
কোন মামলা হয়ে থাকলে দ্রম্নত বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে এ ধরনের সহিংস ঘটনা তদারকি করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা, ক্ষতিগ্রসত্ম ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা করা, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে পরিবর্তন আনা, নির্বাচনে জয়লাভের পর পরাজিতদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, জয়লাভের পর তাৎক্ষণিক বিজয়োলস্নাস পরিহার করা, জনগণের রায়কে স্বীকৃতি দেয়া, স্থানীয় প্রশাসনকে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, এ সব ঘটনা তদন্তের জন্য প্রতিজেলায় একটি করে স্বল্পমেয়াদি কমিটি বা কমিশন গঠন করা ইত্যাদি।
The Daily Janakantha 13/06/2011
ভোলার 'ভেণ্ডারবাড়ী' এক অভিশপ্ত রাতের ভয়াবহ সাক্ষী
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (২)
তপন বিশ্বাস ॥ ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে যত্রতত্র। খুন, লুণ্ঠন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অগ্নিনসংযোগসহ সব মানবতাবিরোধী সহিংসতায় আক্রান্ত নিরীহ ব্যক্তি ও পরিবারের শোক, দুঃখ ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তারই কিছু কাহিনী তুলে ধরা হলো ধারাবাহিকের এ পর্বে।
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংস ঘটনা ঘটলেও সকল মাত্রা ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করে ভোলা জেলার লালমোহন থানার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের অন্নদা প্রসাদ গ্রামের ভোন্ডারবাড়ীর ঘটনা। নির্বাচনের পর পরই শুরু হয় দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ এবং ভেন্ডারবাড়ী থেকে থানা প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন এমনকি সংবাদকর্মীরাও নির্বাচনে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। বাড়িঘর লুটপাট, চাঁদা দাবি, এমনকি নারী ধর্ষণের অজস্র ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই পুলিশের নথিভুক্ত হয়নি।
তদনত্ম কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১ অক্টোবর রাতে হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় লালমোহনের বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর অন্নদা প্রসাদ গ্রামের আশপাশের গ্রামের সংখ্যালঘু মহিলারা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল গ্রামের চার পাশের ধানৰেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভেন্ডারবাড়ী। অর্ধশতাধিক মহিলা তাদের সম্ভ্রম রৰার জন্য সেখানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সে বাড়িটিও সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি। নরপিশাচদের আগুনে আত্মাহুতি দিল শত নারী। শত শত বিএনপি সন্ত্রাসী ৮/১০টি দলে বিভক্ত হয়ে অত্যনত্ম পরিকল্পিতভাবে ওই রাতে হামলা চালায়। একের পর এক দল হামলা চালিয়ে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়ের ধর্ষণ করতে থাকে। শত চেষ্টা করেও মহিলা তাদের সম্ভ্রম রৰা করতে পারেনি। অনেক সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশপাশের জলাশয়ের ধানৰেতে। মহিলারা পানিতে ঝাঁপিয়ে সম্ভ্রম রৰার চেষ্টা চালালে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এ সন্ত্রাসীরা তাদের সনত্মানদের পানিতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিলে সনত্মানের জীবন রৰায় তারা উঠে আসতে বাধ্য করে। আর উঠে আসলেই তারা গণধর্ষণের শিকার হয়। এভাবে ধর্ষিত হয় আট বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হয়েছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা, মা, মেয়ে, শাশুড়ি, পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে এক সঙ্গে। এ সময় ছেলের চেয়েও ছোট বয়সী সন্ত্রাসী ধর্ষণ করেছে মায়ের চেয়েও বেশি বয়সের নারীকে। সন্ত্রাসীরা ছাড়েনি পঙ্গু নারী শেফালী রানী দাসকেও। পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের মতো সন্ত্রাসীদের কবল থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে শেফালী রানীও পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। পঙ্গু শেফালী পালানোর চেষ্টাকালে পুকুর পাড়ে হলুদ ৰেতে পড়ে যায়। তখন দুই সন্ত্রাসী তাকে ধরে ফেলে এবং তার পরনের কাপড় ছিঁড়ে তাকে বিবস্ত্র করে দুই সন্ত্রাসী পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সন্ত্রাসীদের পাশবিক অত্যাচারে এক পর্যায়ে শেফলী জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পলফ্যাশন হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো হয়। সম্ভ্রম হারিয়ে অনেকেই লজ্জায়, ভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়।
তদনত্ম রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভেন্ডারবাড়ীতে নারকীয় এ পাশবিক ঘটনার বিএনপি সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম ছিল অন্নপ্রসাদ গ্রামের আবু, সেলিম, দুলাল, জাকির পিং আঃ খালেক। এছাড়া ওই সন্ত্রাসীদের মধ্যে ছিল দুলাল পিতা-কব্বর আলী সাং চাঁদপুর, আলমগীর পিতা- আঃ মুন্নাফ সাং অন্নদাপ্রসাদ, সোহাগ মিয়া সাং অন্নদাপ্রসাদ, নজরম্নল পিতা- মৃত বদিউজ্জামান সাং চাঁদপুর, মোঃ আক্তার পিতা-আঃ হাই সাং ফাতেমাবাদ গং জোর পূর্বক গংগাচরণ দাস পিতা- মৃত বৈকুন্ঠ কুমার দাস সাং অন্নপ্রসাদের বাড়িতে প্রবেশ করে তার বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। আসামিরা তার স্ত্রী শেফালী বালা দাস ও কন্যা সুষমা রানী দাসকে ধর্ষণ করে। ওই গ্রামের অনেকে এখন ভারতে অবস্থান করছে। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে আশ্রয় নেয়া ৬০/৭০ মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়।
তদনত্ম কমিশন লালমোহনের ভেন্ডারবাড়ী নারকীয় পৈশাচিক ঘটনায় জড়িত কিছু সন্ত্রাসীদের নাম উলেস্নখ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ১. দুলাল, পিতা- আলী আকবর, সাং চাঁদপুর। ২. ইব্রাহিম খলিল, পিতা-মৃত মৌলভী মোহাম্মদ, সাং অন্নদাপ্রসাদ। ৩. আকতার (৩৫) পিতা-জাফর উল্যাহ, সাং চাঁদপুর। ৪. সাইফুল (৪০) পিতা-ওসমান গনি, সাং-অন্নদাপ্রসাদ। ৫. শাহাবুদ্দিন পিতা- আঃ হাই সাং-চাঁদপুর। ৬. মোতাহার (৩৫), পিং- সামছুল হক, সাং-ফাতেমাবাদ, ৭. ভুট্টো, পিতা- মোসত্মফা, সাং-অন্নদাপ্রসাদ, ৮.নান্নু (৩৭), পিতা- লুৎফর রহমান, সাং ফাতেমাবাদ। ৯. আলমগীর, পিতা-আবুল হাশেম, সাং-সৈয়দাবাদ, ১০ সেলিম, পিতা-ইয়াসিন মাস্টার, সাং-অন্নদাপ্রসাদ। ১১. জাকির, পিতা- আঃ মালেক। ১২. নজরম্নল, পিতা বদিউজ্জামান, ১৩. আবু, পিতা- জলিল, ১৪. মিজান, পিতা-ইসহাক, ১৫. ইদ্রিস, পিতা-আঃ কাদের ১৬. মোশারফ, পিতা- শাহাবুদ্দিন মিয়া, ১৭. বাবলু, পিতা-নুরম্নজ্জামান, ১৮. কামরম্নল, পিতা-নুরম্নজ্জামান, সর্ব সাং অন্নাদপ্রদান লালমোহন বোলা। অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জন যাদের নাম ঠিকানা তদনত্মের সময় কেউ বলেনি বা বলতে পারেনি।
অনত্মঃসত্ত্বা জয়নত্মী-সংগ্রামের কাহিনী ॥
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর অষ্টাদশী গ্রাম্য গৃহবধূ জয়নত্মী যখন প্রথম সনত্মানের জন্মমুহূর্তে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে, ঠিক সে সময় দিন দুপুরেই বেলা আনুমানিক ৩টায় ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার সাত নন্বর পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের জাহাজমারা গ্রামে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। তদনত্ম রিপোর্টে বলা হয়, স্থানীয় বিএনপি নেতা ইলিশা কান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর মাতবরের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী দা, ছুরি, লাঠি ও বলস্নমসহ তাদের কুঁড়েঘরে হামলা চালায়। হামলায় গ্রামবাসী ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন ঘরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হামলা চালাতে থাকে। জয়নত্মীর শাশুড়ি মুক্তিরানী একজন স্থানীয় ধাত্রীকে দিয়ে তার শিশু প্রসব করাচ্ছিল। শিশু প্রসবের মুহূর্তে সন্ত্রাসীরা দা ও ছুরি দিয়ে জয়নত্মীর কুঁড়ে ঘরের বেড়ায় কোপ মারতে থাকে। ধাত্রী সন্ত্রাসীদের ভয়ে ও আতঙ্কে পালিয়ে যায়। ঘরে শুধু অসহায় জয়নত্মী ও তার শাশুড়ি। সন্ত্রাসীরা তখনও ঘরের বেড়া ভাঙার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ মুহূর্তে জন্ম নেয় একটি পুত্র সনত্মান। হতবুদ্ধি মুক্তিরানী কোন উপায় না দেখে জয়নত্মীকে ভালভাবে জড়িয়ে ধরে নবজাতককে পরনের শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ঘরে নিয়ে অপর দিকের বেড়া ভেঙে জয়নত্মীকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। পরবর্তীতে ওই অবস্থায় দৌড়ে পালায় পাশের ধানৰেতে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। সদ্যপ্রসূতি মা জয়নত্মীর তখন দৌড়ে পালানোর মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু মৃতু্য ভয়ে ভীত মুক্তি রানী তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তখনও পর্যনত্ম সদ্যজাত শিশুটিকে মায়ের নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করার সময় পায়নি মুক্তি রানী। তাদের মতো অনেকেই সেই ধানৰেতের মধ্যে অপেৰাকৃত উঁচু একটি জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এসে জড়ো হয়েছিল। সেখানে একজনের কাছ থেকে একটি বেস্নড নিয়ে শিশুটির নাড়ি কাটে মুক্তি রানী। রাত নয়টা পর্যনত্ম সেখানে থেকে সন্ত্রাসীদের চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করে তারা পুনরায় ঘরে ফিরে যায়। এ ঘটনার কারণে সদ্য ভূমিষ্ঠ সনত্মানের নাম রাখা হয় সংগ্রাম।
গ্যাং রেফ ॥ নির্বাচনের পরদিন বিভিন্ন স্থানে চলে গ্যাংরেফ। ঝালকাঠির নলছিটিতে একই পরিবারের চম্পা রানী, পুতুল রানী, মিনতী রানী, মালতী রানীকে এক সঙ্গে ধর্ষণ করে এ নরপিশাচরা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা নৌকা মাকর্ায় ভোট দেয়ার অপরাধে রাতে বাড়িতে এসে লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে দল বেঁধে একই পরিবারের চার মা-মেয়ে ধর্ষণ করে।
দুই সনত্মানের সামনে মাকে ধর্ষণ ॥ ঘটনাটি ঘটে সাতৰীরার আশাশুনিতে। গ্রামের নাম খালিয়া। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পৰে প্রচারে অংশ নেয়ায় একই গ্রামের বিএনপি ক্যাডার শাহাজাহান, বটু, ইসমাইল ও সোবহানের লোলুপ দৃষ্টি থেকে সম্ভ্রম রৰা করতে পারেনি তারামন বিবি। ১৫ অক্টোবর রাতে স্বামী ও পুত্র-কন্যার সামনে গণধর্ষণের শিকার হয়।
মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ ॥ নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে ফরিদপুরের ভাংগায় আজিমনগর গ্রামে একটি সংখ্যালঘু পরিবার বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি মৌলবাদী সমর্থকরা ওই পরিবারের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেই ৰানত্ম হয়নি। ঘরের মধ্যে সারারাত মদ খেয়ে পৈশাচিক উলস্নাসে মায়ের সামনেই নকুল মালোর কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণ করে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয় ২০০১ সালের ৬ অক্টোবর রাত ৯টায় ভাংগায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের ভাই পলাশ, মোঃ সেকেন, জামাল, এসকেন, কামাল ও টেক্কা নামে সাত বিএনপি সমর্থক ও সন্ত্রাসী আজিমনগর গ্রামে ওই সংখ্যালঘুর বাড়িতে হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা নৌকায় ভোট দেয়ার মজা দেখাচ্ছি বলে পরিবারের কর্তাকে খুঁজতে থাকলে প্রাণভয়ে তিনি ঘরের পেছনের দরজা খুলে পালিয়ে যায়। এসময় সন্ত্রাসীরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় মায়ের সামনেই ওই পরিবারের কলেজ পড়ুয়া কন্যাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ধর্ষণ করতে শুরম্ন করে। মা সন্ত্রাসীদের হাতে পায়ে ধরে মেয়ের ইজ্জত ভিৰা চাইলে সন্ত্রাসীরা তাকেও বেদম মারপিট করে। রাত ১টা পর্যনত্ম এ পৈশাচিক নির্যাতন শেষে সন্ত্রাসীরা ঘরের দামি জিনিসপত্র লুট করে কলেজ পড়ুয়া ওই মেয়েকে অন্যত্র তুলে নিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করে এবং ভোরে তাকে গুরম্নতর আহত অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে যায়। ভোরে ওই পরিবারটি ধর্ষিতা মেয়েসহ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পালিয়ে যায়। ঘটনার সংবাদ পেয়ে পুলিশ গোপালগঞ্জ থেকে পরিবারটিকে এলাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েটিকে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সন্ত্রাসীরা ঘটনার পর থেকে ওই পরিবারসহ অন্যান্য সংখ্যলঘু পরিবারকে হুমকি দেয় এবং এ ঘটনা কাউকে না বলার হুমকি দেয়।
The Daily Janakantha 14/06/2011
পূর্ণিমা ছবিরানী মহিমা_এভাবেই সেদিন বাড়ে সম্ভ্রমহারাদের সারি
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৩)
তপন বিশ্বাস ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের নরপিশাচরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ধর্ষণে মেতে ওঠে। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে মানবতা লাঞ্ছিত হয়। এদের সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, শারীরিক নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মতো অসংখ্য ঘটনায় মানবতা ক্রন্দনরত। এ জাতীয় আরও কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো ধারাবাহিকের এই সংখ্যায়।
২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অগি্নসংযোগসহ সব মানবতাবিরোধী সহিংসতায় আক্রান্ত নিরীহ ব্যক্তি ও পরিবারের শোক, দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। অনেকে তদন্ত কমিশনের সামনে এসে বর্ণনা করেছে লোমহর্ষক কাহিনী। আবার কেউবা ভয়ে এখনও মুখ খুলতে সাহস পায়নি। নাম প্রকাশ না করেও কেউ কেউ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে তদন্ত কমিশনের সামনে।
এক পরিবারের তিন সংখ্যালঘু নারীর সম্ভ্রমহানি ॥
বরিশাল সদর থানার চরমোনাই ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামে তিন সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করে নরপিশাচরা। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজারচর গ্রামের পবিত্র কুমার মিস্ত্রি হোগলাপাতার ব্যবসা করত। দুই ছেলে, দুই মেয়ে, বোন আর স্ত্রীকে নিয়ে সে বসবাস করত। নির্বাচনের পর গ্রামে সন্ত্রাসীদের দাপট বেড়ে যাওয়ায় বড় মেয়ে গৌরীকে শহরে পাঠিয়ে দেয়। এতে বড় মেয়ে রৰা পেলেও সম্ভ্রম রৰা করতে পারেনি পরিবারের অন্য নারীরা। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে বিএনপি সন্ত্রাসী বজলু, পিতা- মকবুল হাওলাদার, আতাহার তালুকদার, পিতা অজ্ঞাত উভয় সাং রাজারচর, থানা-কোতোয়ালি, বরিশালসহ ১০-১২ অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী পবিত্র কুমারের বাড়িতে এসে তাকে না পেয়ে স্ত্রী-সনত্মানদের পরনের কাপড় ছাড়া বাকি মালামাল লুট করে নিয়ে যায় এবং পবিত্রকে দেখা করতে বলে। কিন্তু প্রাণভয়ে পবিত্র দেখা না করলে সন্ত্রাসীরা ১৩ অক্টোবর রাত সোয়া ১টার দিকে সিঁধ কেটে তার ঘরে প্রবেশ করে দরজা ভেঙ্গে ফেলে। এ সময় সন্ত্রাসীরা ঘরে ঢুকে পবিত্রর স্ত্রী পারম্নল বালা (৪০), মেয়ে প্রিয়ঙ্কা রানী মিস্ত্রি (পুষ্প) (১৪), চাচাত বোন সোমা রানী মিস্ত্রিকে গণধর্ষণ করে। ঘটনার দীর্ঘ ৯ বছর পর ভিকটিমরা তদনত্ম কমিশনের কাছে এ ঘটনা প্রকাশ করেছে। ঘটনার সময় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও আসামিরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
কিশোরী পূর্ণিমাকে গণধর্ষণ ॥ পনেরো বছর বয়সের দশম শ্রেণীর ছাত্রী পূর্ণিমা গণধর্ষণের শিকার হয়ে অনেকটা বাকরম্নদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়া থানার দেলুয়া গ্রামের অনিল কুমার শীলের পরিবারের ওপর ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী অক্টোবর মাসের ৮ তারিখ রাতে চালানো হয় বর্বরতম অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন। রাতে জোরপূর্বক বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার-নির্যাতনের এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা অনিল শীলের ছোট মেয়েকে তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ঘটনার ৩/৪ দিন পর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ধর্ষিত ছাত্রী ও তার পরিবারকে সাংবাদিদের সামনে হাজির করলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসী মোঃ খলিল মিয়া, মোঃ আঃ জলিল মিয়া, মোঃ লিটন মিয়া, মোঃ আলতাফ হোসেন, মোঃ আনোয়ার হোসেন, মোঃ রেজাউল হক, মোঃ আঃ মালেক, মোঃ হোসেন আলী, মোঃ ছাবেদ আলী, মোঃ আঃ রউফ, মোঃ আঃ মান্নান, মোঃ মজনু, মোঃ ইউসুফ আলী মোঃ মমিন হোসেন, মোঃ মনসুর আলী, মোঃ জহুরম্নল ইসলাম, মোঃ মেভেন মিয়া, মোঃ ইয়াসিন আলী, মাঃ আব্দুল মিয়া, মোঃ বাবুল মিয়াসহ ২৫-৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল রাতের অাঁধারে অনিল শীলের বাড়িতে হানা দেয়। তারা অনিলের ছোট মেয়ে পূর্ণিমা রাণী শীলকে অপহরণ করতে গেলে তার স্ত্রী বাধা দিতে আসে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের হামলায় পূর্ণিমার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বাড়ির সবাইকে মারধর করে তারা পুর্নিমাকে তুলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
উলস্নাপাড়া হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীৰার্থিনী পূর্ণিমা ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন নিজ গ্রাম দেলুয়া ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রাথর্ী আব্দুল লতিফ মির্জার নির্বাচনী এজেন্ট ছিল। তার মা বাসনা অন্য ভোটকেন্দ্র মহিলা আনসারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পৰে কাজ করার কারণে এই পরিবারের ওপর নেমে আসে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীদের এই পাশবিক অত্যাচার। অবশ্য এ ঘটনায় কয়েকজনের শাসত্মিও হয়েছে।
ছবি রানী ধর্ষণ ॥ তদন্ত কমিশন সরেজমিন তদনত্ম করতে গেলে বাগেরহাট সার্কিট হাউসে এসে নির্মম নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করে গণধর্ষণের শিকার হওয়া ছবি রানী। ধর্ষণের সময় তার বয়স ছিল ২০ বছর। ছবি রানী কমিশনের সামনে বলে, ২০০২ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি নেতা মলিস্নক মিজানুর রহমান ওরফে মজনু ও বাশার কাজীর নির্দেশে সন্ত্রাসী মজনু রহমান (বিএনপি থানা আহ্বায়ক), আবুল বাসার, তায়েব নুর, কামাল শিকারী, কামাল ইজারাদার, বজলুর রহমান, পলাশ, মাঝে শিকদার, ইল ফরাজী, হিমু কাজী, জিন্না নুর প্রহরী, ইমদাদ, এমএ মান্নান, হারম্নন মলিস্নক, মোসত্মাফিজুর রহমান, হাফিজ উদ্দিন, আলতাফরা সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টা থেকে সাড়ে ৭টায় তাকে বিএনপি অফিসে ডেকে নিয়ে গণর্ধষণ করে। পরে মাথার চুল কেটে দেয়। পরে নগ্ন ছবি করে যৌনাঙ্গে বালু ও কাঁচের গুঁড়া ঢুকিয়ে দেয়। পানি খেতে চাইলে প্রসাব করে তা খেতে দেয়। জবানবন্দী দেয়ার সময় তার শরীরের কয়েকটি চিহ্ন কমিশনের সদস্যদের দেখান। এ সময় ছবি রানী তদনত্ম কমিশনকে জানায়, বাগেরহাট আদালতে এ মামলা চলাকালে বিএনপির তখনকার সভাপতি ও বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমএএইচ সেলিম তাঁর বাগেরহাটের বাড়িতে ডেকে নিয়ে জোর করে মামলা মীমাংসাপত্রে স্বাৰর করিয়ে নেয় এবং সন্ত্রাসীর হুমকির মুখে সাৰী হাজির করতে না পারায় বাধ্য হয়ে মামলাটি প্রথমে ঢাকা, পরে খুলানা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে স্থানানত্মর করে।
ধর্ষিত কিশোরী মহিমার আত্মহনন ॥ ঘটনাস্থল রাজশাহীর পুঠিয়া। কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামের আঃ হান্নানের ১৪ বছরের মেয়ে মোছাঃ মহিমা খাতুন। ২০০২ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বিকেলে নিজ বসতবাড়ির পূর্বপাশ্বের একটি কাঁঠাল গাছ থেকে পাতা পেড়ে ছাগলকে খাওয়ানোর সময় বিএনপি সমর্থিত সন্ত্রাসী ফরিদ, পিতা- সেকেন্দার, ফরম্নক, পিতা-মোতালেব, সেলিম, পিতা- খলিল, সাং সেনবাগ, উজ্জল, পিতা-মোশারফ, সাং-পীরগাছা, মোশারফ হোসেন, পিতা-জবেদ আলী, সেকেন্দার আলী, পিতা- মৃত মাহাতাব, আঃ মোতালেব, পিতা- মৃত সৈয়দ আলী উভয় সাং কাঁঠালবাড়ীয়া ও খলিল, পিতা- লোকমান, সাং বড় সেনবাগ পুঠিয়া তাকে জোরপূর্বক পাশর্্ববর্তী আবু বক্করের আখৰেতে নিয়ে যায় এবং আসামিরা তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে সন্ত্রাসীরা মহিমা খাতুনের বিবস্ত্র অবস্থায় ছবি তোলে। ঘটনাটি প্রথমে আপোস মীমাংসার চেষ্টা চলে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে আপোস মীমাংসা না হওয়ায় মহিমা খাতুন সম্ভ্রমহানির অপমানে ঘটনার চারদিনের মাথায় ১৯ ফেব্রম্নয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিষপান করে । সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
The Daily Janakantha 15/06/2011
কমলার ক্ষতচিহ্ন সেদিন চূর্ণ করে দেয় আলতাফ চৌধুরীর দম্ভ
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৪)
তপন বিশ্বাস ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিহিংসার রাজনীতি। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অপরাধের দায় মেটাতে হয়েছে অসংখ্য সংখ্যালঘু নারীকে ইজ্জত দিয়ে। এ আঘাত সইতে না পেরে কেউ অপ্রকৃতস্থ হয়েছে সারা জীবনের জন্য। কেউ অত্মহনন করেছে। কেউ কেউ মুখ বুজে সহ্য করলেও তাদের দীর্ঘ নিশ্বাসে আজও স্মরণ করে ২০০১-এর সেই নির্বাচনকে। এই নারকীয় ঘটনায় অনেকে হাত-পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। এ জাতীয় আরও কিছু ঘটনা থাকছে ধারাবাহিকের এই পর্বে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর মুহূর্তেই খুন, লণ্ঠন, অগি্ন সংযোগ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ধর্ষণ শুরু করে বিএনপি-জামায়াত জোটের নরপিশাচরা। আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা, প্রতিবন্ধী কেউ এদের হাত থেকে রৰা পায়নি। হায়নারা যেন দল বেঁধে নামে ধর্ষণে। ৯ বছরের শিশু কাজলীও ধর্ষণের শিকার হয়েছে এই নরপশুদের হাতে। মদ খেয়ে ধর্ষণে মাতোয়ার হয়ে ওঠে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। এ সময়ে ঘটনা শুধু মধ্যযুগীয় নয়, যে কোন সময়ের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।
গোটা বাঙালী জাতি এ নারকীয় ঘটনার ধিক্কার জানিয়েছিল, জানিয়ে যাচ্ছেও। জাতি চায় মানুষরূপী এই নরপশুদের দৃষ্টানত্মমূলক বিচার হোক। রাজনীতি করা বা বিশেষ কোন দলকে সমর্থন করা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষের গণতান্ত্রিক এই অধিকারকে নস্যাত করতে নারকীয় এই ঘটনা করে উলস্নাস করে এরা । গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাছে বাংলার মানুষের অনেক প্রত্যাশা। ভিন্ন মত থাকবে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে পছন্দ করে, তাঁকে চায় বলেই তো ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবার ৰমতায় এসেছে। জাতির আকাঙ্ৰা গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। এদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ জাতীয় ঘৃণ্য অপরাধ করতে সাহস না পায়।
নির্বাচনের দিন রাতে অর্থাৎ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বরিশালের গৌরনদীর চানসি গ্রামে সাবিত্রী দাস গণধর্ষণের শিকার হয়। মধ্যরাতে ১০/১২ সন্ত্রাসী সাবিত্রী রানী দাসের ঘরে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। এ সময় তার স্বামী বাধা দিলে তাকে মারধর করে ঘরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। স্বামী চোখের সামনে স্ত্রী সাবিত্রীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে একে একে ধর্ষণ শুরম্ন করে। পালাক্রমে রাতভর চলে এই ধর্ষণ প্রক্রিয়া। ভোরে সন্ত্রাসীরা তাদের ফেলে চলে যায়। এ ঘটনায় সাবিত্রী রানী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ঘটনার ১০ বছর পর তদনত্ম কমিশন গিয়ে তাকে অপ্রকৃতস্থ দেখতে পায়।
নির্বাচনের পরদিন অর্থাৎ ২০০১ সালের ২ অক্টোবর রাতে যুবদল ও ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ফরিদপুরে ডিগ্রী পড়ুয়া এক সংখ্যালঘু মেয়ের প্রতি। সবেমাত্র এইচএসসি পাস করে ডিগ্রীতে ভর্তি হওয়া সংখ্যালঘু পরিবারের এই মেয়েটির প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টি আগে থেকেই ছিল। নির্বাচনের পর দেশজুড়ে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট শুরম্ন হলে রাতের অাঁধারে তারাও বাসনা মেটাতে ছুটে আসে মেয়েটির বাড়িতে। মেয়েটিকে তার বাড়িতে ফেলে মা-বাবার চোখের সামনে গণধর্ষণ করে নরপিশাচরা। ১০ বছর পর তদনত্ম কমিশন ফরিদপুরে তাদের বাড়ি গেলে মেয়েটির মা-বাবা কমিশনের সদস্যদের পা জড়িয়ে ধরে। এ সময় কমিশনকে তারা জানায় ঘটনাটি তারা ভুলে যেতে চায়। মেয়েটিকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন কারণে এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায় তারা সে অনুরোধ জানায়।
নাবালিকা কাজলী ধর্ষণ ॥ ২০০২ সালে ২১ মার্চ রাতে রাজশাহীর বাগমারা থানার কোন্দা গ্রামে মোঃ রজব আলী রাতের খাওয়া শেষে তার স্ত্রী অলকজান একটি ঘরে এবং তার ছেলে জুয়েল ও মেয়ে রজুফা ওরফে কাজলী (৯) অপর একটি ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে বিএনপি সমর্থিত ১. আশরাফুল আলম, ২. ইসরাফিল, ৩. রহিম উদ্দিন, ৪ মকলেছুর (মকে), ৫ জাকিরম্নল ওরফে সান্টু, ৬. আসকান ওরফে আমিনুল ও আমজাদ হোসেন সর্ব সাং কোন্দা, বাগমারা তালা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে নাবালিকা মেয়ে কাজলীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। এ সময় বাধা দিতে এতে কাজলীর ভাইয়ের গলায় এক সন্ত্রাসী চাকু ধরে। অপর এক সন্ত্রাসী চাকু দিয়ে কাজলীর যৌনাঙ্গের কাছে পাজামা কেটে তাকে ধর্ষণ করে। পাজামা কাটার সময় চাকুর আঘাতে কাজলীর যৌনাঙ্গের অংশ বিশেষ কেটে রক্তাক্ত জখম হয়। নরপশুরা ওই অবস্থায় কাজলীকে ধর্ষণ করে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা কাজলীর চিৎকারে তারা মা-বাবা অন্য ঘর থেকে ছুটে এলে সন্ত্রাসীরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় মুমূষর্ু অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে পরে ডাক্তারের পরামর্শে রাজশাহীতে সেবা ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করায়। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক বাগমারা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন/২০০০ এর ৯(১)/৩০ রজু হয়। মামলাটি তদনত্ম শেষে সকল আসামির বিরম্নদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলা চার আসামির যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করে আদালত।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর দম্ভোক্তি ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর রূপে চলছে নির্বাচনোত্তর সহিংসতা। খুন, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, সম্পদ লুট, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত সশস্ত্র ক্যাডার। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী নির্দ্বিধায় অস্বীকার করছেন এ সকল ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও জনমতের চাপে সরকারী কর্মকর্তা ও দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারযোগে বরিশালের আগৈলঝড়ায় যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে আয়োজিত এক মঞ্চে স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন আহম্মেদ স্বপন বলেন, 'সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কোন নির্যাতন না হওয়া সত্ত্বেও পত্রিকায় মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপিয়ে সরকারকে হেয় করা হচ্ছে।' স্বপনের এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সামনে হাজির হয় রাজিহার ইউপি সদস্য কমলা রানী ওরফে কালা বউ। কমলা রানী মঞ্চে উঠে উপস্থিত জনতার সামনে শাড়ি খুলে তার ওপর বিএনপি সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের বর্ণনা দেন। পিনপতনের সত্মব্ধতা ভেঙ্গে উপস্থিত জনতা ধিক্কার ধ্বনি দিয়ে মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করে। কমলা রানী স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পৰে পোলিং এজেন্ট ছিল বলে নির্যাতন করে তার বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করে দেয়া হয়।
The Daily Janakantha 16/06/2011
আওয়ামী লীগ করে এ অপরাধে মরদেহ ঠাঁই পায় না গোরস্তানে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৫)
তপন বিশ্বাস ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সহিংস ঘটনা ভয়াবহ রূপ নেয়। ফ্রি স্টাইলে চলে খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ সহিংস ঘটনা। আওয়ামী লীগ করার অপরাধে মৃতু্যর পর গোরস্তানেও ঠাঁই মেলেনি। গাছের সঙ্গে বেঁধে দিনেদুপুরে রামদা দিয়ে দু'পা কেটে পঙ্গু করে দেয়ার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে তখন। সরকার ও প্রশাসন ছিল নীরব।
মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর সহিংস ঘটনা তদনত্ম কমিশন গঠন করে। ২০০৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর এ সংক্রানত্ম গেজেট জারি করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের কমিশন মর্মস্পর্শী তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার পর দেড় মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনকভাবে সরকার নীরব রয়েছে। সরকারের রহস্যজনক এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অথচ এ ঘটনা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে মানবতা লাঞ্ছিত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ল-ভ-। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাবিরোধী শক্তি বাংলাদেশজুড়ে শুরম্ন করে নারকীয় তা-ব। এদের সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, শারীরিক নির্যাতন ও অগি্নসংযোগের মতো অসংখ্য ঘটনা মানবতা ক্রন্দনরত।
বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের এই আক্রোশকে ধিক্কার জানিয়েছে মানুষ। এই মানুষ নামের নরপিশাচদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মির দাবি জানাচ্ছে দেশের বিবেকবান মানুষ। মহাজোট সরকারের কাছে বিভিন্ন মানুষ এই দাবি জানিয়েছে জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে। নির্বাচনপরবর্তী সহিংস কা- নিয়ে এরই ধারাবাহিক দেখে অনেক বিবেকবান পাঠক ফোনে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জনকণ্ঠকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং জনকণ্ঠের মাধ্যমে এই নরপশুদের বিচারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনকণ্ঠ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রিপোর্টটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। পাঠকদের অভিমত, শুধুমাত্র প্রকাশ করলেই সরকারের সকল দায়িত্ব সম্পন্ন হয়ে যাবে না। এই নরপশুদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এ জাতীয় অপরাধ করার কথা চিনত্মাও না করে।
আওয়ামী লীগ করায় গোরসত্মানেও ঠাঁই হলো না ॥ ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৪ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীরা পাবনার সুজানগরে গুপিনপুর গ্রামে ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জিয়াউর রহমান, পিতা মৃত মুজিবর রহমানের বসতবাড়ি ভাংচুর, পুকুরের মাছ ও ঘরের সোনা-দানাসহ বিভিন্ন রকমের মালামাল লুট এবং বাড়ির দু'টি টিনের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যতৰণ পর্যনত্ম ঘরগুলো পুড়ে ভস্মীভূত না হয় ততৰণ পর্যনত্ম সন্ত্রাসীরা বাড়িতে অবস্থান করে তার বাবাকে শারীরিকভাবে অমানুষিক নির্যাতন করায় তিনি স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গুরম্নতর অবস্থায় মুজিবর রহমানকে ওই দিনই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরবর্তী ১৪ অক্টোবর তিনি মৃতু্যবরণ করেন। পরদিন তার মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি গুপিনপুর গোরসত্মানে দাফন করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সুজানগর উপজেলার সাতবাড়ীয়া ইউনিয়নে তৎকালীন চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হোসেন ও তার বাহিনী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে লাশটি স্থানীয় গোরসত্মানে দাফন করতে দেয়নি। কোন উপায় অনত্ম না দেখে অনন্যোপায় হয়ে পরবর্তীতে লাশটি বাড়ির আঙ্গিনায় দাফন করা হয়। ২০০১ সালের ২২ অক্টোবর বিকেল ৩টায় কুলখানি অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মির্জা আব্দুল জলিলসহ কয়েক শ' মানুষ। কিন্তু তোফাজ্জল হোসেনের মেজ ছেলের (মোঃ রবি) নেতৃত্বে তাদের দলীয় বাহিনী অনুষ্ঠানের সব খাবার ছিনিয়ে নেয় এবং শত শত মানুষের সামনে তার কবরের ওপর প্রস্রাব করে। সন্ত্রাসীরা মৃত মুজিবর রহমানের স্ত্রী (মোসাঃ রাশেদাকে বানু) বেধকড় মারধর করে আহত করে। থানায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা নেয়নি। কমিশন সরেজমিনে তদনত্মে গিয়ে জানতে পাওে যে স্থানীয় তৎকালীন সংসদ সদস্য সেলিম রেজা হাবীবের ইন্ধনে এই ঘটনা ঘটেছে এবং সেলিম রেজা হাবীবের প্রভাবের কারণেই থানায় মামলা নেয়া হয়নি।
আওয়ামী ভক্তের দু'পা কেটে নিল ॥ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে যশোরের চৌগাছা-ঝিকরগাছা আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করায় স্থানীয় চৌগাছার মুক্তারপুরের ভাদড়া গ্রামের জিনাত উলস্নাহ ম-লের ছেলে আওয়ামী লীগ ভক্ত আব্দুল বারিক ম-ল তার বাড়িতে গরম্ন জবাই করে ভোজের আয়োজন করে। সেই আক্রোশে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হলে বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী ১. মোঃ সেলিম, পিতা-মোঃ শাছুর রহমান, ২. মোঃ মানিক, পিতা- শাহাজাহান, ৩. মোঃ তরিকুল ইসলাম, পিতা- আব্দুল বিশ্বাস, ৪. মোঃ ওবায়দুল ইসলাম, পিতা-ওয়াহেদ আলী, ৫. মোঃ মোড়ল, পিতা-ওয়াহেদ আলী, ৬. আহাম্মদ আলী, পিতা-হাতেম বিশ্বাস, ৭. আব্দুল আজিজ, পিতা-বক্ত জামাল, ৮. মোঃ আবু ম-ল, পিতা- মোঃ খালেক, ৯. মোঃ ইব্রাহিম, পিতা-জাভেদ আলী ম-ল, ১০. মোঃ আঃ রশিদ, পিতা- মাসুদ আলী, সর্বসাং ভাদড়া, চৌগাছা, যশোর দলবদ্ধ হয়ে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভিকটিমকে তার বাড়িতে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিনেদুপুরে রামদা দিয়ে কোপ দিয়ে দু'পা কেটে ফেলে। এতে ভিকটিমের বড় ছেলে বাধা দিতে গেলে তাকেও বেঁধে দু'পায়ে গরম রড ঢুকিয়ে দেয়। এতে বাবা ও ছেলে উভয়ই পঙ্গু হয়ে যায়। তারা দু'জনই যশোর সার্কিট হাউসে এসে কমিশনের কাছে মর্মস্পশী এ ঘটনার বর্ণনা দেয়। গ্রামের লোকেরা মসজিদের লাশ বহনকারী খাটিয়ায় করে এই পিতা-পুত্রকে যশোর সার্কিট হাউসে আনে।
অকালে ঝরে গেল মেধাবী ছাত্র ইমরুল কায়েস ॥ সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা গ্রামে আব্দুর রশিদ তালুকদারের পুত্র মেধাবী ছাত্র ইমরম্নল কায়েস কনককে পাশর্্ববর্তী সোনামুখী মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে চালিতাডাঙ্গা বাজারের পাশে ওৎঁপেতে থাকা স্থানীয় ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ১. প্রিন্স, পিতা-মোজাম্মেল, ২. খালেক, পিতা-মৃত ছুটকা ম-ল, ৩. শামিম, পিতা-সোলায়মান, ৪. শামিম, পিতা- জহিরম্নল ওরফে খোকা, ৫. শাহজামাল ওরফে শাহা, পিতা-পর্বত তালুকদার, সর্বসাং চালিতাডাঙ্গাসহ মোট ১৭ জন চাইনিজ কুড়াল, রামদা, লোহার রড, হকিস্ট্রিক ইত্যাদি দ্বারা ইমরম্নল কায়েস কনককে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। এই সময় কনক বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার করলে প্রাণ ভয়ে কেউ এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করলে পর দিন সে মারা যায়। কনকের চাচা আনোয়ার হোসেন ঠা-ু আসামিদের বিরম্নদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ প্রাথমিক পর্যায়ে আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর হয়ে ওঠে। সপ্তাহখানেক পরেই রহস্যজনক কারণে এই তৎপরতার ঝিমিয়ে পড়ে। আসামিরা তাদের সহযোগীসহ বাদী ও সাৰীদের ওপর নানা প্রকার হুমকি দিতে থাকে। সন্ত্রাসীদের এই হুমকির মুখে বাদী ও সাৰীরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। মামলাটি বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলা নং এসসি ২৮/২০০৭।
The Daily Janakantha 17/06/2011
ছাত্র শফিক, অধ্যক্ষ গোপাল মুহুরীকে প্রাণ দিতে হয় সন্ত্রাসীর বুলেটে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৬)
তপন বিশ্বাস ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে শুরম্ন হয় প্রতিহিংসার রাজনীতি। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অপরাধের দায় মেটাতে হয়েছে অসংখ্য সংখালঘু নারীকে ইজ্জত দিয়ে। ছাত্রলীগ করার অপরাধে পালিয়েও প্রাণ বাঁচাতে পারেনি অনেকে। পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে নাজিরহাট কলেজের অধ্যৰ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে খুন করা হয়েছে দিনে দুপুরে। জাতির পিতার নামে নামকরণ করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মহাবিদ্যালয় লুট করে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয় এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এ আঘাত সইতে না পেরে কেউবা অপ্রকৃতিস্থ হয়েছে সারা জীবনের জন্য। কেউবা অত্মহনন করেছে। কেউ কেউ মুখ বুঁজে সহ্য করলেও তাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস আজও স্মরণ করে ২০০১-এর সেই নির্বাচনকে। এই নারকীয় ঘটনায় অনেকে হাত-পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে।
২০০১ সাল, নির্বাচন পরবর্তী ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে। সারা দেশে একযোগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ল-ভ-, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির নারকীয় তা-ব, হত্যা, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, নির্যাতন ও অগি্নসংযোগসহ এমন কোন হীন কাজ নেই যা ঘটেনি। পাশবিক, জানত্মব আক্রোশ, হিংস্রতা। ঘটনার ৯ বছর পর হলেও সরকার তদনত্ম কমিশন করেছে। ইতোমধ্যে কমিশন তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু তার পরও সরকার রহস্যজনকভাবে নীরব রয়েছে। সরকারের এই ভূমিকায় জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, তা হলে কিী লোকদেখানোর জন্য এই তদনত্ম কমিশন গঠন করা হয়েছে।
পালিয়ে বাঁচতে পারেনি ছাত্রলীগ নেতা বুলেট ॥ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায় সংখ্যালঘু নারী-পুরম্নষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তখন পালিয়ে বেড়ায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি গৌরনদী কলেজের ছাত্রলীগ নেতা শফিকুর রহামন বুলেট বেশ কিছুদিন পালিয়ে থেকে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরে দেখে তার মা ভীষণ অসুস্থ। অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে সে বাড়ি থেকে বের হয়। এ সময় গৌরনদী গোপাল শীলের সেলুন থেকে বিএনপি ক্যাডার কালু, সেলিম, মাসুদ, সুমন, রম্নবেল, স্বপন, বাবুসহ ১০/১২ জন তাকে ধরে শহরের খাদ্য গুদামের পাশে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন চালাতে শুরম্ন করে। প্রাণে বাঁচার লৰ্যে এক পর্যায়ে বুলেট পার্শ্ববর্তী খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিএনপি ক্যাডাররা তাকে পানিতে চুবিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। শফিকুর রহমান বুলেট বাড়িতে দু'দিন চিকিৎসা নেবার পর তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার মৃতু্য হয়। এ ব্যাপারে গৌরনদী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং-০৬, তারিখ ২৬-১১-২০০১। ধারা ৩০২/৩৪ দ. বি.। তদনত্ম শেষে আসামি ১. মাসুদ ওরফে হকার মাসুদ, পিতা- মধু মিয়া হাওলাদার, সাং-চরগাধাতলী, ২. রম্নবেল, পিতা- আব্দুর রহিম, ৩. স্বপন ওরফে ছোট স্বপন, পিতা-সেকান্ডার কুলি ওরফে কুদ্দা ওরফে সেকান্দার আরী বয়াতী, সাং-চরগাধাতলী, ৪. সজল, পিতা-মধু মিয়া হাওলাদার, সাং-চরগাধাতলী, ৫. সুমন কর্মকার, পিতা-অজ্ঞাত, সাং চরগাধাতলী, ৬. বাবু ওরফে শামীম মোলস্না, পিতা- মৃত হাতেম মোলস্না,, সাং-টিকাসার, ৭. জুয়েল, পিতা-মৃত বদিকুল ইসলাম খলিফা, সাং-কাশেমাবাদ, ৮. শাহ আলম খান, পিতা-জসিম উদ্দিন খান, সাং-টিকাসার, সর্ব থানা-গৌরনদী, বরিশাল। এদের বিরম্নদ্ধে গৌরনদী থানার অভিযোগপত্র নং-১৫, তারিখ-২৬-০১-২০০২ আদালতে দাখিল করা হয়।
অধ্যৰ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যাকাণ্ড ॥ ২০০১ সালের ১৬ নবেম্বর, শুক্রবার। সকাল সোয়া ৭টার দিকে চার অজ্ঞাত পরিচয় অস্ত্রধারী যুবক ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর ব্যসত্মতম জামাল খান রোডের বাসায় হাটহাজারী কলেজের অধ্যৰ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে (৬০) মাথায় স্বয়ক্রিয় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সন্ত্রাসীরা সকলেই জামায়াত শিবিরের ক্যাডার। জামায়াত শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা সুপরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকা- ঘটায়। এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ১৬ নবেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরীর জামাল খান, মোমিন রোড এলাকায় অঘোষিত হরতাল পালিত হয়। রাসত্মাজুড়ে ছিল প্রতিবাদ মিছিল।
জামায়াত শিবিরের অবৈধ অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত নাজিরহাট ডিগ্রী কলেজের অধ্যৰ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর নৃশংস হত্যাকা-ের ব্যাপারে তাঁর স্ত্রী রেলওয়ে অডিক কর্মকর্তা উমা মুহুরী বাদী হয়ে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। কোতোয়ালি থানার মামলা নং-৪২ তাং ১৬-১২-২০০১ ধারা ৩০২/১২০(খ)। মোট ১১ আসামির বিরম্নদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বিচার শেষে গিট্টু নাসির, তসলিম উদ্দীন ওরফে মন্টু, আজম ও আলমগীর কবির ওরফে বাইজা আলমগীরের ফাঁসির আদেশ হয়। পরবর্তীতে গিট্টু নাসির ক্রস ফায়ারে মৃতু্য বরণ করে। আসামি মহিউদ্দিন ওরফে মাইন উদ্দীন, হাবিব খান, শাজাহান এবং সাইফুল ওরফে ছোট সাইফুলসহ ৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দেয় আদালত।
নাজিরহাট কলেজের অধ্যৰ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী ছিলেন একজন আওয়মী লীগ ভক্ত। এছাড়া তিনি সকল ধরনের অন্যায়, অনিয়ম ও অবৈধ চাপের বিরম্নদ্ধে সোচ্চার থেকে কলেজ পরিচালন করতেন। এ কারণে জামায়াত-শিবিরের স্বার্থান্বেষী ক্যাডাররা তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। হত্যাকা-টি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী শুক্রবার বন্ধের দিনকে সন্ত্রাসীরা বেছে নিয়েছে।
অধ্যৰ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর মৃতু্যর পর পরই চট্টগ্রামবাসী এ হতাকা-ের বিরম্নদ্ধে বিৰোভে ফেটে পড়ে। কালো পতাকা উঁচিয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়কে মিছিল বের হয়। বিৰুব্ধ জনতার সকল মিছিল এসে জামাল খান রোডে জড়ো হয়। হত্যাকা-ের পর থেকে জামাল খান সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রতিবাদ আর মিছিলের জনপদে পরিণত হয়।
শিৰা প্রতিষ্ঠানে অগি্নসংযোগ ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোট ৰমতায় আসার পর বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীরা ২, ৩, ৪, ৫, ৬ অকক্টোবর/২০০১ পর্যনত্ম বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল ও স্কুল-কলেজের ফার্নিচার, রিঙ্া, ভ্যান, নছিমন করিমন লুটপাট করে নিয়ে যায়। তারা বুড়ি-ভৈরব নদীর ওপর কাঠের ব্রিজটি ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় যাতে কেউ প্রতিরোধ করতে না পারে। সন্ত্রাসীরা ওয়াজেদ আলীকে দোকান থেকে বের করে টাকাসহ মালামাল লুট করে। ওয়াজেদ আলীর ওই বাজারে একটি মুদি দোকান, ১টি সার ও কীটনাশকের দোকান এবং ডেকোরেটরের দোকান ছিল। এ ছাড়া শাহজাহানের ১টি সাইকেল পার্টসের দোকানও লুটপাট করে। সন্ত্রাসীরা তাদের সঙ্গে আনা রামদা, চাইনিজ কুড়াল, সাবল, হাতুিড়, লাঠ, লোহার রড দিয়ে দোকান পাট ভাংচুর করে। সন্ত্রাসীরা মোঃ শাহাদাত খাঁ, পিতা-ওসমান খাঁ, সাং-মাতগাছিয়া, থানা-কালীগঞ্জের বাড়িঘর ভাংচুর ও তাকে মারধর করে। সন্ত্রাসীদের আক্রমণে বাজারটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা বঙ্গবন্ধু নামের কলেজ থাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মহাবিদ্যালয় ভেঙ্গ গুঁড়িয়ে দেয় এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
The Daily Janakantha 18/06/2011
ইজ্জতের মূল্য ১৯ হাজার টাকা, ভাঙ্গা হয় সোহেল তাজের বাড়ি
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ-৭
তপন বিশ্বাস ॥ ২০০২ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে মাতুভুঞা ইউনিয়নের উত্তর চানপুর গ্রামের আবুল হোসেনের পুত্র অসংখ্য অভিযোগের আসামি সন্ত্রাসী হারুনের নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের বিএনপি-জামায়াতের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল মহেশপুর গ্রামে সংখ্যালঘু দাসপাড়াতে ধর্ষণ, হামলা ও লুটপাট চালায়। রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের নারকীয় তা-বে জয়বিহারী দাসের বাড়ি, ডাক্তারবাড়িসহ বিভিন্ন বাড়ির লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এ সময় সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ তিন সন্তানের জননী পুতুল রানী দাসকে (৩২) ঘরের দরজা বন্ধ করে তার স্বামী-পুত্রের সামনে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তদনত্ম কমিশনের কাছে পুতুল বলে, ইজ্জত রৰার জন্য আমি সন্ত্রাসী হারম্ননের হাতে এক হাজার টাকা ঘুষ দেই। কিন্তু তাতেও আমার ইজ্জত রৰা হয় না। নরপিশাচরা আমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এই রাতে চানপুর গ্রামের ফারম্নক, শাহআলম ও মোঃ ইউনুস হেমনত্ম কুমার দাসের স্ত্রী আলো রানীকেও পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
সাকা চৌধুরীর তাণ্ডব ॥ সংখ্যালঘু নির্যাতনে কোন দিনই পিছিয়ে ছিলেন না সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকাচৌ)। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সারাদেশে যখন চলছে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানা নির্যাতন, তখন তিনিও শরিক হলেন এ কর্মকাণ্ডে। জাতীয় সংসদের এই নির্বাচনে বিজয়ী হন সাকাচৌ। এরপর তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর নিজ গ্রাম গহিরায় যান। গ্রামে যাওয়ার পর তাঁর সন্ত্রাসী ক্যাডার ফজল হক, আবু তাহের ও বিধান বড়ুয়াকে হুকুম দেন নির্বাচনে তাঁর বিপৰে প্রচারে অংশ নেয়া মহিলা মেম্বার রত্না ঘোষের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করার। সন্ত্রাসীরা সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় গিয়ে মহিলা মেম্বারের বাড়িতে আগুন দিলে এই আগুন পাশর্্ববর্তী আরও তিনটি বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় রত্না ঘোষের বাড়ির সঙ্গে চন্দন ঘোষ, সনজিত ঘোষ ও অজিত ঘোষের বাড়িও আগুনে ভস্মীভূত হয়। এভাবে সাকাচৌর ক্যাডাররা বাড়িঘরসহ ৩৭টি স্থাপনা ধ্বংস করে। নির্বাচনে বিপৰে কাজ করার অপরাধে শতকাতুল ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন ফার্নিচার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হুমকির মুখে বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
ইজ্জতের মূল্য সাড়ে ১৯ হাজার টাকা ॥ ২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী ৯ অক্টোবর রাতে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার সবদালপুর ইউনিয়নের নহাটা গ্রামের পালপাড়ার পাশের গ্রামের বাকি মিয়ার নেতৃত্বে মিজানুর রহমান, জাহাঙ্গীর, বাবলু, আবু সাইদ, কেনালসহ ২০-২৫ জন বিএনপি সন্ত্রাসী একই গ্রামের অনিল পাল, নিখিল পালসহ কয়েকজনের বাড়িতে ভাংচুর, মারপিট ও লুটপাট করার একপর্যায়ে কলেজ ও স্কুল পড়ুয়া দুই তরম্নণীকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী মাঠে রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পরের দিন সংশিস্নষ্টদের বিরম্নদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন ধারায় মামলা হয়। তদনত্ম শেষে আসামিদের বিরম্নদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়। ২০০২ সালের ১২ এপ্রিল পাশর্্ববর্তী আমতৈল দাখিল মাদ্রাসায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঘটনাটি আপোস মীমাংসা করার জন্য এক সালিশ বৈঠকে বসে। ওই সালিশ বৈঠকের মোড়লগণ গণধর্ষণের শিকার হওয়া দুই তরম্নণীর ইজ্জতের মূল্য ১৯ হাজার ৫শ' টাকা নির্ধারণ করে।
সোহেল তাজের বাড়ি ভাংচুর ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০১ সালের ১ ডিসেম্বর জননিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রেৰিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার ৰতির আশঙ্কায় তৎকালীন প্রাধনমন্ত্রী (বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেত্রী) বেগম জিয়ার বিরম্নদ্ধে তানজিম আহমদ সোহেল তাজ (এমপি) এবং রহমত আলী (সাবেক প্রতিমন্ত্রী) (এমপি) যথাক্রমে কাপাসিয়া এবং শ্রীপুর থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওই ডায়েরির বিষয় প্রকাশ পেলে স্থানীয় বিএনপি নেতা মাওলানা রম্নহুল আমীনের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস, সাবেক প্রতিমন্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য রহমত আলীর বাড়ি এবং শ্রীপুর থানা অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে, এমনকি বিএনপির এই সন্ত্রাসীরা শ্রীপুর থানা অফিসে ঢুকে ভাংচুর করে। থানা পুলিশ অসহায় অবস্থায় পালিয়ে আত্মরৰা করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অর্ধবেলা হরতাল আহ্বান করে এবং ময়মনসিংহ রোডে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যনত্ম অবরোধ করে রাখে।
The Daily Janakantha 19/06/2011
ভারতে চলে গেছে অনেকে সম্ভ্রমহারা মেয়েদের নিয়ে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৮)
তপন বিশ্বাস ॥ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এ নির্যাতনের অনেক ঘটনা রয়ে গেছে আড়ালে, অনেকে মামলা করেছে। অনেকে সে সাহসও পায়নি। অনেকে আবার লোকলজ্জা ও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে ধর্ষণের ঘটনাও গোপন রেখেছে। এ জাতীয় অসংখ্য ঘটনা রয়ে গেছে লোকচৰুর অন্তরালে। 'মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ' শীর্ষক ধারাবাহিকের এ পর্বে থাকছে ২০০১ নির্বাচনপরবর্তী ভোলার চরফ্যাশনের সহিংসতার কিছু চিত্র।
দ্বীপজেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রায় দুই মাস যাবত চলে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক, বিশেষে করে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন, এমনকি সংবাদ মাধ্যমও নির্যাতনের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। বাড়িঘর লুটপাট, জোরপূর্বক চাঁদাবাজি, এমনকি নারী ধর্ষণের অজস্র ঘটনা ঘটে এ সময়। এসবের অধিকাংশই পুলিশের নথিভুক্ত হয়নি। অধিকাংশ ভুক্তভোগীরা ভয়ে কোন অভিযোগ পর্যনত্ম করেনি। প্রায় প্রতিটি ৰেত্রে লোকলজ্জা ও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে পরিবারের মহিলারা ধর্ষিত হওয়ার পরও আইনের আশ্রয় নেয়নি বা বিষয়গুলো গোপন রেখেছেন। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি জানলেও বা অনুমান করলেও ৰতিগ্রসত্ম পরিবারগুলো অনেক ৰেত্রেই তা স্বীকার করেনি বা মৌন ছিল। ঘটনার ৯ বছর পর তদনত্ম কমিশন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে অজানা অনেক নির্যাতনের কাহিনী তুলে এনেছে। ভুক্তভোগীরা অনেকে ঘটনার কথা স্বীকার করলেও কেউ কেউ লিখিত বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেছে। এমনকি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবেন বলে অনেকে তাদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে তদনত্ম কমিশনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।
অনেকে নির্যাতনের পর এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন; কেউ বা দেশ ত্যাগ করেছেন। এমন অসংখ্য ঘটনার কয়েকটি মাত্র ঘটনা তুলে ধরা হলো। চরফ্যাশনের ওসমানগঞ্জের উত্তর চরফ্যাশন গ্রামের টিকেন্দ্র চন্দ্র দাস ওরফে আইচা রাম দাসের স্ত্রী অমীয় রাণী দাস বাড়িঘর বিক্রি করে ঢাকায় অবস্থান করছে। নির্বাচনের প্রায় এক মাস পর চারদলীয় জোটের কিছু সন্ত্রাসী রাতে তাদের বাড়িতে দরজা প্রবেশ করে। এ সময় দশম শ্রেণী পড়ুয়া তার কন্যা শিল্পীকে সন্ত্রাসীরা তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা শুরম্ন হওয়ার পর শিল্পীর পিতা-মাতা তাকে দাসকান্দি গ্রামে চাচার বাড়ি পাঠায়ে দেয় বলে সন্ত্রাসীরা তাকে সে রাতে পায়নি। তবে সন্ত্রাসীরা তার বাড়িঘর লুটপাট করে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায় এবং ময়েকে ফিরিয়ে এনে তাদের হাতে তুলে দেয়ার হুমকি দিয়ে চলে যায়। এরপর পরিবারটি দুই মাস বাড়িছাড়া ছিল। পরে ভিটেমাটি বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে।
উত্তর চরফ্যাশনের রঞ্জন কুমার দাসের স্ত্রী শোভা রানী দাস তদনত্ম কমিশনকে জানায়, নির্বাচনের পরপরই কিছু সন্ত্রাসী তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে নগদ ১৭ হাজার টাকাসহ মালামাল লুট করে নিয়ে যায় এবং তাকে মারপিট করে ডান হাত ভেঙ্গে দেয়। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হলেও ধর্ষণের কথা অস্বীকার করেন তিনি। এ ব্যাপারে তার কোন অভিযোগ নেই এবং অভিযোগ করতে রাজিও নয়। তার কথায় প্রতীয়মান হয় সন্ত্রাসীদের অনেককেই সে চেনে। কিন্তু নাম বলেনি। সে আরও বলে, আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সকল বাড়িতে লুটপাটের ঘটনা ঘটে এবং অনেক মহিলা এ সময় ধর্ষিত হয়।
উত্তর চরফ্যাশন গ্রামের সুনীল কুমার রায়ের স্ত্রী আরতী বালা রায় জানায়, নির্বাচনের পর লুটপাট ও অত্যাচার শুরম্ন হলে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ঘরের তেমন কিছু ৰতি না হলেও ৩৫টি হাঁস সন্ত্রাসীরা নিয়ে যায়। আরতী আরও জানায়, পরিস্থিতি কিছুটা শানত্ম হলে এলাকায় ফিরে জানতে পারে শোভা রানী সন্ত্রাসী দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছিল। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, অবিনাশ কুমার দাসের স্ত্রী সুজলা রানী দাস সম্পর্কে জানা যায়, নির্বাচনের পর সন্ত্রাসী দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার কয়েক মাস পর তারা বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে চলে যায়। বর্তমানে তারা ভারতে অবস্থান করছে। তাদের বাড়ি মোট দুই দফায় আক্রমণ হয়। সন্ত্রাসীরা মহিলার নাকের নাকফুল নিয়ে যায়। প্রতিটি ঘরে ঢুকে তারা তলস্নাশি চালায় এবং সোনা-গহনা, হাঁস-মুরগি, গরম্ন-ছাগলসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। উলেস্নখ্য, ওই এলাকায় নাকফুল নেয়ার অর্থ হলো মহিলার সম্ভ্রমহানি। পরিবারের অনেক সদস্য ভয়ে ধানৰেতে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং জোঁকের কামড়ের শিকার হয়। সন্ত্রাসীরা মূলত সন্ধ্যার পর বাড়িঘরে আক্রমণ শুরম্ন করত। এ ঘটনায় পরিবারটি ৰোভে, লজ্জায় বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি।
একই গ্রামের বলরাম দাসের স্ত্রী কণিকা রানী দাসের ব্যাপারে জানা যায় তাদের বাড়িতে ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর রাতে একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আক্রমণ করে মালামাল লুট করে এবং তার সম্ভ্রমহানি ঘটায়। এছাড়া স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেও শারীরিক নির্যাতন চালায়। এ ঘটনায় তারা পুলিশকে কিছু জানানোর সাহস পায়নি। অমর চন্দ্র দাসের স্ত্রী কল্যাণী দাস সম্পর্কে জানা যায়, গভীর রাতে সন্ত্রাসীরা তাদের বাড়িতে এসে ধান-চাল, জামাকাপড়সহ বাড়ির সকল মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। এ সময় তারা তার মেয়ের খোঁজ করে এবং মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। কিন্তু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে এবং সেখানে নেই এ কথা শুনে সন্ত্রাসীরা ৰিপ্ত হয়ে স্বামীর সামনে কল্যাণীকে ধর্ষণ করে। স্বামী বাধা দিতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাকে মারধর করে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে উপযর্ুপরি ধর্ষণ করে। এ ঘটনার পরও ভয়ে ও লোকলজ্জার ভয়ে তারা থানায় কোন অভিযোগ করেনি। আসামিদের নাম বলতেও অস্বীকৃতি জানায়। সনত্মোষ কুমার দাসের স্ত্রী শেফালী রানী দাস সম্পর্কে জানা যায়, ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে ২০/২৫ জনের একটি সন্ত্রাসী দল তার বাড়িতে প্রবেশ করে। সন্ত্রাসী আক্রমণের বিষয়টি টের পেয়ে পরিবারের লোকজন নিকটবর্তী বাজারে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। সন্ত্রাসীরা বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে চলে যায়। সন্ত্রাসীরা চলে গেলে তারা বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু কিছুৰণ পর রাতে আর একদল সন্ত্রাসী আক্রমণ করে। এ সময় স্বামী-স্ত্রী দুজনকে তারা বেদম মারপিট করে এবং অবশিষ্ট মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় সন্ত্রাসীরা মুখে কাপড় বেঁধে আসে। এ ঘটনার কিছুদিন পর তারা সকলে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছে।
এছাড়াও প্রকৃতি রানী দাস, স্বামী লিটন দাস; রীতা রানী দাস, স্বামী-সুব্রত দাস; শোভা রানী দাস, স্বামী নিরঞ্জন দাস; শেফালী রানী দাস, স্বামী সনত্মোষ কুমার দাস, সর্বসাং দশনাথ আলীগাঁও, উত্তর চরফ্যাশন, কর্তারহাট; ২০০১ সালের নির্বাচনের পর নির্যাতনের কারণে ৰোভে, ভয়ে, লজ্জায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে তারা ভারতে অবস্থান করছে। ঝর্ণা রানী দাস, স্বামী-সুনীল কুমার দাস, সাং-দশনাথ আলীগাঁও, বাড়িঘর ছেড়ে বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। এর কেউই বর্তমানে চরফ্যাশনে বসবাস করে না। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, নির্বাচনের পর চারদলীয় জোটের সন্ত্রাসীরা বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট ও মারধর করে। বাড়ির মহিলারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলেও এলাকাবাসী জানায়। এলাকার অনেক পরিবারই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। কিন্তু ভয়ে কিংবা পুনরায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আক্রমণের শিকার হতে হবে মনে করে অধিকাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করছে না, আগেও করেনি।
The Daily Janakantha 20/06/2011
নির্বাচনোত্তর নির্যাতিত ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নেয় রামশীলে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৯)
তপন বিশ্বাস॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রামশীল গ্রাম হয়ে উঠেছিল পার্শ্বববর্তী এলাকার নির্যাতিতদের আশ্রয়স্থল। গ্রামবাসীর তত্ত্বাবধানে সেখানে খোলা হয়েছিল লঙ্গরখানা। নিরাপত্তা বিধানে গঠন করা হয় ২১ সদস্যের কমিটি। নির্যাতিত, ধর্ষিতদের সান্তনা দিয়ে রৰা করা হয় আত্মহত্যার হাত থেকে। প্রশাসনের দায়সারা আশ্বাসে বিশ্বাস করে এলাকায় ফেরেনি নির্যাতিতরা। এ সম্পর্কিত কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো ধারাবাহিকের এই পর্বে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার রামশীল একটি দুর্গম ও প্রত্যনত্ম গ্রাম। কোটালীপাড়া থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিঃ মিঃ। রামশীল এলাকায় শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পরদিন থেকেই রামশীলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল পাশর্্ববর্তী থানা/এলাকা থেকে নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা। এলাকাটি হিন্দু অধু্যষিত হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এই এলাকাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। নিজ এলাকার ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ায় শত শত নারী-পুরম্নষ ও শিশুদের মধ্যে যাদের নির্যাতন করা হয় তাদের কয়েকজন বরিশালের আগৈলঝাড়ার রাজিহাঁড়ি ইউনিয়নের তৎকালীন সদস্য কমলা রানী রায়, শেফালী রানী সরকার, বাবুলাল মুন্সী, হরিহর রায়, রিয়াজ মোহন রায়, মহেন্দ্রনাথ রায়, বাসুদেব রায়, দেবুরাজ রায়, শানত্মিরঞ্জন রায়, বিজয় কৃষ্ণ রায়, শচিন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ। এখানে আরও আশ্রয় নিয়েছিল গৌরনদী থানার উত্তর চাঁদসী, কাপালী, অশোক কাঠী ও আগৈলঝড়ার কোদালদহ গ্রামের সহস্রাধিক পরিবারের মানুষ। এই রামশীলে আশ্রয় নিয়েছিল উজিরপুর থানা এলাকার নির্যাতিত পরিবারের সদস্যরাও।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাগেরহাটের মোলস্নারহাট থানার জয়ঘা, চাঁদেরহাট, মাদারতলি, বুড়িগাংনি, বড়গাওলা, চাঘদা গ্রামের নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু পরিবারের অনেক সদস্য রামশীলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। আশ্রয় নিয়েছিল স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন বাড়িতে। রামশীল কলেজ ভবন ও সামনের মাঠ পরিণত হয়েছিল এক আশ্রয় শিবিরে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা আশ্রয় নিয়েছিল এই আশ্রয় শিবিরে। আশ্রয় নিয়েছিল গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাগেরহাট থেকে পালিয়ে আসা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমর্থকরা। রামশীলে আশ্রয় নেয়া আশ্রিতদের অনেকেই চরম দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। নির্যাতিতদের অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আসার সময় প্রয়োজনীয় অর্থ-কাপড়চোপড় সঙ্গে আনতে পারেনি। আশ্রিতদের মধ্যে খাবারের অভাব ছিল প্রকট। গ্রামবাসী তাদের সাধ্যানুযায়ী খাবার রান্না করে দিয়েছে, সকলে তা ভাগ করে খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। প্রায়দিন অনেককে আধাবেলা উপোস করতে হয়েছে। আশ্রিতদের সঙ্গে আশ্রয়দাতাও খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছে। নির্যাতিতদের চিকিৎসাসেবা ছিল না বললেই চলে। সরকারী-বেসরকারী সাহায্যও তারা পায়নি। তদনত্ম কমিশন তাদের কর্মকা-ের অংশ হিসেবে বহুল আলোচিত এই রামশীল পরিদর্শন করে। পরিদর্শন কালে তারা স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল বিশ্বাস, কার্তিক চন্দ্র বাড়ৈ, মেম্বার রামশীল, নিত্যলাল বালা, ডগলাস স্কুলের প্রধান শিৰক, স্থানীয় মন্দির সেবায়েত নবীন চন্দ্র রায়, মৃণাল কানত্মি হালদার, ইউপি চেয়ারম্যান অসীম বিশ্বাস, প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সচিন্দ্র নাথ, রামশীল কলেজের অধ্যৰ, প্রফেসর জয়দেব বালাসহ স্থানীয় বিভিন্ন সত্মরের লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করে। মতবিনিময়কালে বিশ্বদেব রায় জানান, তার বাড়িতে প্রায় ৩০ জনের মতো আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি তাঁর দোতলা ঘরটি আশ্রিতদের জন্য ছেড়ে দেন এবং সাধ্যমতো খাবার সরবরাহ করেন। নিহার রঞ্জন বাড়ৈ জানান, নির্বাচনের পরদিন হতেই আগৈলঝাড়া এলাকা থেকে নির্যাতিত লোকজন আসতে শুরম্ন করে। ৪ অক্টোবর ঘরবাড়ি ছাড়া নির্যাতিত মানুষের ঢল আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল রাজেন্দ্র চন্দ্র, রাজিহার ইউনিয়নের কমলা দেবীসহ অনেকে। তিনি কমিশনের নিকট কমলা দেবীর বাড়িতে লুটপাট ও নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরেন।
প্রাক্তন মেম্বার কার্তিক চন্দ্র রায় সচিন্দ্রসহ কয়েকজন মিলে আশ্রিতদের থাকা, খাওয়া ও নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করেন। এজন্য তখন গঠন করা হয় ২১ সদস্যের একটি কমিটি। গ্রামবাসীর সহায়তায় একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়। মন্দ্রির সেবায়েত নবীন চন্দ্র রায় জানান, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাগেরহাটের মোলস্নাহার এলাকা থেকে হিন্দু, মুসলমান, নির্বিশেষে হাজার হাজার নির্যাতিত মানুষ এই রামশীলে আশ্রয় নেয়। আশ্রিতদের মধ্যে অনেক মা-বোনই ধর্ষিত হয়ে এসেছে বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এলাকার সকলে মিলে তাঁদের সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে রামশীলের আশ্রয় গ্রহণকারীদের সাহায্য করে। একপর্যায়ে প্রায় প্রতিদিন ১৫/১৬ মণ করে চাল খরচ হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে সময় ব্যক্তিগতভাবে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। এলাকাবাসীর ধারণা সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছিল এই রামশীলে।
আশোক বৈদ্য কমিশনের সামনে এসে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন এভবে-"আমি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তবে শুনেছি পাকহানাদের নির্যাতনের কাহিনী। '৭১-এর নির্যাতন না দেখলেও জোট সরকারের সন্ত্রাসীদের ১ অক্টোবরের নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা দেখেছি। এ নির্যাতন যেন '৭১-এর নির্যাতনকেও অনেক ক্ষেত্রে হার মানিয়েছে। রামশীলে অনেক মা-বোনকে দেখেছি নির্যাতনের পর, অনেক শিশু খেতে পায়নি ঠিকমতো। আমাদের বাড়িতে প্রায় দুই শ' আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অনেক ধর্ষিত মা-বোন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আমরা তাদের বুঝিয়ে নিবৃত করেছি। নির্যাতিত মানুষের অসহায় মুখ ও বোবা কান্নার রোল যেন আজও রামশীলের আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।"
স্থানীয় প্রশাসনের পৰ থেকে রামশীলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের প্রত্যৰ ও পরোৰভাবে নিজ নিজ এলকায় ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী রামশীল আশ্রয়কেন্দ্র পরির্দশনের কথা ছিল বলে এলকাবাসী জানায়। কিন্তু তিনি যাননি। ২০০১ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন গোপালগঞ্জের ডিসি, বরিশালের ডিসি, এসপি আসেন রামশীলের আশ্রিতদের খোঁজখবর নিতে। তাঁরা আশ্রিতদের নিজ গ্রামে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে কেউই বাড়ি ফিরে যেতে রাজি হয়নি। কারণ এর মধ্যে যাঁরা বাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল তাঁরা পথিমধ্যে কেউবা মার খেয়েছেন, কেউবা সন্ত্রাসীদের তাড়া খেয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাই কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাসের পরও তারা কেউ বাড়ি ফিরে যেতে রাজি হয়নি।
The Daily Janakantha 21/06/2011
অত্যাচারের প্রকৃতি ছিল ধর্ষণ দখল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (১০)
তপন বিশ্বাস ॥ সুদূরপ্রসারী লক্ষ নিয়ে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর সহিংস ঘটনা চালানো হয়। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এই সহিংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে। মূলত সহিংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে খ্যাত সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে সমর্থক সংখ্যা হ্রাস ও হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভোটদান থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে ভোটের ভারসাম্য বিনষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত করা হয়েছে। যখন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করা হয় তখন তাদের পৰে কোন রাজনৈতিক সর্মথন ছিল না। নির্বাচনোত্তর জয়ী রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চরদলীয় জোট সমর্থক সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের সহায়তায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর সহিংস আক্রমণের সময় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় আওয়ামী নেতৃবৃন্দ এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সে কারণে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। প্রতিপৰের তুলনায় ৰমতার ভারসাম্যে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোন বাধার সম্মুখীন না হওয়ায় এক প্রকার বিনা বাধায় তারা নিরীহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর এই নারকীয় নির্যাতন চালায়।
তদনত্ম কমিশন মনে করে, ২০০১ নির্বাচনপরবর্তী নারকীয় সহিংস ঘটনায় পেছনে তৎকালীন অযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দায়ী। চারদলীয় জোট শপথ নেয়ার আগে এই নির্যাতনের সময় রাষ্ট্রভার ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হতে। তখন প্রশাসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জানমাল রৰা না করে বরং জোটের সন্ত্রাসী বাহিনীকে মদদ যুগিয়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিল আত্মগোপনে, তার ওপর প্রশাসনও ছিল নীরব। এতে চারদলীয় জোটের সন্ত্রাসীরা দিনে রাতে তান্ডব চালিয়েছিল। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লৰ্যে ২০০১ সালের ১৬ জুলাই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল, তাতে ছিল মূলত চারদলীয় জোটের অনুসারীদের প্রাধান্য। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই রাতে শপথ নেয়ার পরৰণেই ওই রাতে ১৩ গুরম্নত্বপূর্ণ সচিবকে বদলির মাধ্যমে তার বহিপর্্রকাশ ঘটে। মুহূর্তে তারা ১ হাজার ৪শ' কর্মকর্তাকে বদলি করে। ডিসি, এসপি, ইউএনও, বিভাগীয় কমিশনার, ওসিসহ সব গুরম্নত্বপূর্ন পদে রদবদল ঘটিয়ে চারদলীয় জোটের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাদের আস্থাভাজনদের পছন্দমতো পদে বসায় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
তদনত্ম কমিশন মাঠপর্যায়ে তদনত্মকালে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা বিশেস্নষণে চার প্রকৃতিতে সব সহিংস ঘটনাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্পত্তি দখল সংক্রানত্ম সন্ত্রাস, মানসিক অত্যাচার, শারীরিক অত্যাচার যার চরমরূপ হলো ধর্ষণ ও হত্যা। এই চার ধরনের সন্ত্রাসের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে সকলে সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে। এই ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। কিন্তু তার বদলে তারা সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়। নির্বাচনোত্তর সহিংসতার প্রকটরূপ প্রত্যৰ করে শক্ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ার অপরাধে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর, সাবের হোসেন চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম, কর্নেল (অব) শওকত আলী, লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, ড. মুনতাসীর মামুন প্রমুখকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশের বিভক্তি এবং পাকিসত্মান নামক রাষ্ট্রের জন্মের মধ্যদিয়ে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাংলা বিভক্ত হয়। এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে তখন থেকে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততা শুরম্ন হতে থাকে। পাকিসত্মানে হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে উপেৰিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এর একটি গ্রম্নপের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পৃক্ত হয়। যেহেতু বাঙালীর এই অন্দোলনটি ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ছিল না এবং ভাষা থেকে শক্তি আহরণ করে ছিল। তাই বলা যায় বাঙালী মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের লৰ্যে এটাই ছিল প্রথম অসাম্প্রদায়িক লড়াই। আন্দোলন যতই অগ্রসর হতে থাকে বাংলাদেশের আঞ্চলিক এবং ভাষাগত পরিচয় ততই উন্মোচিত হতে থাকে। পাকিসত্মানের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রত্যাখ্যান করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সংগঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যালঘুদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। এ সময় পূর্বপাকিসত্মানে হিন্দুদের ওপর মারাত্মক আঘাত হনে পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেৰতাকে মূল নীতি হিসেবে ভিত্তি করে ১৯৭২ সালে সংবিধান রচিত হয় এবং ধর্মনিরপেৰতা মৌলিক চার নীতির অন্যতম নীতি হওয়ায় বাংলাদেশে চমৎকার এক উজ্জ্বল অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস সূচনা হয়। কিন্তু সুদূর প্রসরী লৰ্য নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নির্মমভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সপরিবারে নিহত হন তিনি। '৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার পর রাষ্ট্রৰমতা দখল করে খন্দকার মোশতাক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেৰতার কোন স্থান নেই। মোশতাকের পর তৎকালীন সেনানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান ৰমতায় অধিষ্ঠিত হন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে মূলনীতি হিসেবে গণ্য করে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন সময়ের প্রদত্ত বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ভাষা এবং ধর্মনিরপেৰতার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসই হচ্ছে এই ধরনের জাতীয়তাবাদের মূল কথা। বাংলার মানুষ জাতিগতভাবে বাঙালী হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান ৰমতা গ্রহণের পর থেকে তাদের বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হতে হচ্ছে।
জিয়াউর রহমান হত্যার পর অপর সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৰমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হন। তিনিও তাঁর পূর্বসূরির মতোই ৰমতা সংহত করার লৰ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পরিবর্তিতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহকে আরও অগ্রসর করে মৌলবাদী অনুভূতিগুলোকে সর্বাত্মকভাবে জাগরিত করেন। এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই নীতি এবং সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে গুরম্নতর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হয়। এরশাদের পর বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর দল বিএনপি এবং তাঁর স্বামী জিয়াউর রহামনের নীতিগুলো অন্ধের মতো অনুসরণ করেন তিনি । পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্র ৰমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
র্বির্ণত রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলবাদী উন্মাদনার বিসত্মার ঘটতে থাকে। ইসলামের প্রকৃত চেতনায় নয়, বরং বিকৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগড়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল ওই গোষ্ঠী। তারই আলোকে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, লেখক সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, আইনজীবীসহ প্রগতিশীল চিনত্মাধারার ব্যক্তিদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন ও নিপীড়ন এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে।
The Daily Janakantha 22/06/2011
জেলাভিত্তিক তদন্ত, মামলা রিভিউ ও আপীল করার সুপারিশ কমিশনের
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (শেষ)
তপন বিশ্বাস ॥ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন ২০০১ নির্বাচনপরবর্তী নারকীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এ লক্ষে সহিংস ঘটনার প্রকৃতি অনুযায়ী কমিশন ছয়টি সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ওই সময়ে অনেক ঘটনা রয়েছে, যা মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। এ জাতীয় সকল বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে মামলা দায়ের করা, কোন কোন ৰেত্রে মামলা পুনরুজ্জীবিত করা, তদন্ত না করে যে সকল মামলা চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করা হয়, সে সকল মামলার পুনঃতদন্ত করা, কিছু মামলা রিভিউ করা, কিছু মামলা আপীল করা এবং সহিংস প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে বের করতে প্রতিটি জেলায় ছোট আকারে তদন্ত কমিশন বা কমিটি গঠন করা।
সুপারিশে বলা হয়েছে, (ক) কমিশন তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছে, সহিংস ঘটনা পরবর্তীতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে ব্যর্থ হয়েছে। পরবর্তীতে কমিশন বরাবরে অনেকে আবেদন করেছে এবং তার সত্যতাও পাওয়া গেছে। এ ৰেত্রে কমিশনের সুপারিশ হলো- এ জাতীয় ঘটনায় সংশিস্নষ্ট থানায় বিলম্বের সনত্মোষজনক ব্যাখ্যাসহ অভিযোগে উলিস্নখিত আসামিদের বিরম্নদ্ধে এজাহার দায়ের করতে হবে। উলেস্নখ্য, ফৌজদারি আইনে মামলা দায়েরের ৰেত্রে তামাদির কোন প্রশ্ন নেই।
(খ) নির্বাচনোত্তর সহিংস ঘটনার জন্য এজাহার দায়ের করা হলেও এবং সাৰ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাবে সঠিক তদনত্ম ছাড়াই চূড়ানত্ম প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ ৰেত্রে কমিশনের সুপারিশ চূড়ানত্ম রিপোর্টের ভিত্তিতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত আসামিদের বিরম্নদ্ধে পুলিশ প্রশাসন নিজ উদ্যোগে অতিরিক্ত তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারে। ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ১৭৩ (৩বি) ধারা অনুসারে তা আইনসিদ্ধ। অথবা এজাহারকারী/বাদী চূড়ানত্ম প্রতিবেদনের বিরম্নদ্ধে নারাজি দরখাসত্ম দাখিল করতে পারেন। চূড়ানত্ম রিপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের ওপর বাধ্যকর নয় বিধায় নারাজি দরখাসত্ম পাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট এজাহারকারীর জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করে উপকরণ বিদ্যমান থাকলে নিজেই অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারেন। অথবা অতিরিক্ত তদনত্মের নির্দেশ দেবেন।
(গ) এজাহার দায়েরের পর তদনত্ম শেষে চার্জশীট দাখিল করা হয়, কিন্তু সাৰ্য প্রদানকালে রাজনৈতিক চাপে সাৰ্য ওলট পালট করে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ ৰেত্রে সুপারিশ হলো-খালাসের রায় ও আদেশের অসম্মতিতে এজাহারকারী কর্তৃক রিভিশন দায়ের করা যেতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৯ ও ৪৩৯ (এ) ধারা প্রযোজ্য ৰেত্রে প্রয়োগ করা যাবে। রিভিশন তামাদি বাধা হবে না যদি সনত্মোষজনক ব্যাখ্যা দেয়া যায়।
(ঘ) কমিশন তদনত্ম করতে গিয়ে দেখেছে, আসামিদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে কিন্তু চার্জ গঠন করার সময় রাজনৈতিক প্রভাবে ম্যাজিস্ট্রেট/সেশন জজ কর্তৃক ডিসচার্জ আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ৰেত্রে ডিসচার্জ আদেশ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৩০ ধারা বলে সেশন জজের নিকট এবং সেশন জজ দিয়ে থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৩৯ (এ) ধারা বলে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করা যাবে।
(ঙ) মামলার বাদী সাৰী নিয়ে হাজির থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাবে সাৰীদের পরীৰা না করে এরই ধারাবাহিকতায় ২/৩টি বিচারের ধার্য তারিখে সাৰী আসেনি এমন অজুহাত দেখিয়ে মামলা ডিসচার্জ/খালাস করা হয়েছে। এ ৰেত্রে ডিসচার্জ আদেশ হয়ে থাকলে রিভিশন করা যাবে আর খালাস হয়ে থাকলে আপীল করতে হবে।
(চ) কমিশন দেখেছে, আদালতে মামলা চলাকালীন রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৪ ধারা অনুযায়ী প্রসিকিউশন প্রত্যাহারের নির্দেশের প্রেৰিতে বিচারিক আদালতের সম্মতিতে মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ৰেত্রে কমিশনের সুপারিশ হলো-সাধারণত চার্জ গঠনের পূর্বে মামলা প্রত্যাহার করা হলে আসামিদের ডিসচার্জ করা হয়ে থাকে। চার্জ গঠনের পর মামলা প্রত্যাহার করা হলে আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতি আদেশ হয়। উভয় ৰেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট আদেশের বিরম্নদ্ধে সেশন জজের নিকট এবং সেশন জজের আদেশের বিরম্নদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আকারে প্রার্থনা করা যাবে। সরকারের প্রত্যাহার সংক্রানত্ম আদেশে কোন কারণ বা অজুহাত যদি বর্ণিত না থাকে এবং আদালতের সম্মতির আদেশে উপাদানসমূহ বিবেচনা করেছে মর্মে উলেস্নখ না থাকলে উক্ত প্রত্যাহার আদেশ বাতিল হতে পারে। বিশেষ ট্রাইবু্যনাল (বিশেষ ৰমতা আইন) অনুসারে বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল কর্তৃক প্রদত্ত রায় ও আদেশের অসম্মতিতে আপীলের বিধান আছে বিধায় রিভিশন চলবে না, আপীল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করা যায়নি এবং তামাদি আইনের ৫ ধারা বিধান ওই সকল আইনে প্রয়োগ করার সুযোগ না থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৬১ (এ) ধারায় হাইকোর্ট ডিভিশন বরাবর প্রতিকারের আবেদন করা যাবে।
কমিশনের মতামতে বলা হয়েছে, আইনের বিধানসমূহের নানামুখী ব্যাখ্যার সুযোগ থাকায় প্রয়োগের সময় আইন বিশেষজ্ঞদের সুচিনত্মিত সিদ্ধানত্মের আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই উদ্দেশ্য কার্যকর করার লৰ্যে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনি উপদেষ্টা/ আইন শাখার সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি সমন্বয় সেল গঠন আবশ্যক। এছাড়া জেলা পর্যায়ে পিপি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের একজন প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে সংশিস্নষ্ট জেলাসমূহের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট মামলাসমূহ সম্পর্কে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে মর্মে কমিশন মনে করে।
No comments:
Post a Comment